পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত, বিবাদ এবং অপহরণের ঘটনা বহুদিন ধরেই আলোচনার বিষয়। এই অঞ্চলে দেশি-বিদেশি নাগরিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও অপহরণের শিকার হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনায় এই প্রসঙ্গ আবারও সামনে এসেছে। ১৯৮৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত অপহরণ কাহিনি নিচে তুলে ধরা হলো।
২০০১ সালে তিন বিদেশি অপহরণ
১৬ ফেব্রুয়ারি, রাঙামাটির নানিয়ারচর এলাকায় ডেনমার্কভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংস্থার তিন কর্মকর্তা অপহরণ হন। তারা সেখানে সড়ক সম্প্রসারণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে গিয়েছিলেন। অপহৃতদের মধ্যে দুইজন ডেনমার্কের এবং একজন ইংল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন। অপহরণকারীরা প্রায় ৯ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ১৭ মার্চ, রাঙামাটির একটি দুর্গম এলাকা থেকে তিনজনকে মুক্ত করা হয়। তবে মুক্তির সময় গোলাগুলির সরকারি দাবি অস্বীকার করেন অপহৃতরা।
শেল অয়েলের ছয় কর্মকর্তা অপহরণ (১৯৮৪)
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি এলাকার সিজকমুখ অঞ্চল থেকে শেল অয়েলের ছয় কর্মকর্তা অপহরণ হন। প্রথমে তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি তিনজন প্রায় এক মাস পর মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি পান। অপহরণের জন্য একটি সামরিক সংগঠনকে দায়ী করা হয়।
টেলিটকের পাঁচ কর্মী অপহরণ (২০১৩)
৮ জুলাই, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থেকে মোবাইল অপারেটর টেলিটকের পাঁচ কর্মী অপহৃত হন। ১৭ দিন পর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় তাঁদের মুক্তি মেলে। অপহরণের জন্য একটি আঞ্চলিক সংগঠনকে দায়ী করা হয়, যদিও মুক্তির ক্ষেত্রে কোনো মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি বলে জানানো হয়।
৭০ জন নেতা-কর্মী অপহরণ (২০১৩)
১৭ ফেব্রুয়ারি, রাঙামাটির লংগদু উপজেলার কাট্টলীবিল থেকে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের ৭০ জন নেতা-কর্মীকে অপহরণ করা হয়। তারা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাঙামাটি সদরে যাচ্ছিলেন। মুক্তিপণের দাবি জানানো হয় এবং মুক্তি পেতে এক বছরের মতো সময় লাগে।
কল্পনা চাকমা অপহরণ (১৯৯৬)
১২ জুন, জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংগঠক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে মামলা হলেও বারবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় এবং মামলাটি শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়।
ব্যাংক ব্যবস্থাপক অপহরণ (২০২৪)
রুমা বাজারে একটি ব্যাংকে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং ভল্ট ভাঙার চেষ্টা করে। ব্যবস্থাপকের মুক্তির জন্য ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়, তবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুই নারী নেত্রী অপহরণ (২০১৮)
১৮ মার্চ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এক মাস পর তাঁদের খাগড়াছড়ি থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণ (২০২৫)
১৬ এপ্রিল, খাগড়াছড়ির কুকিছড়া থেকে অটোরিকশায় সদরে যাওয়ার পথে পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে একজন একটি ছাত্রসংগঠনের সদস্য ছিলেন। এই ঘটনায় পার্বত্য অঞ্চলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ সামনে আসে। এখনো উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
অপহরণের পেছনের কারণ
সমতলে অপহরণের উদ্দেশ্য সাধারণত মুক্তিপণ হলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সময় এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক বিবাদ। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন এবং প্রশাসনের দুর্বল সমন্বয়ও অপহরণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে অগ্রগতির ঘাটতি ও দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ এসব ঘটনার মূল প্রেক্ষাপট।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে, পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ এখনো সময়ের দাবি।