২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে ধাপে ধাপে সব ধরনের কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব প্রশাসন। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় বিষয়টিকে উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য, কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও যুক্তিসংগত করা।
সম্প্রতি ১০ বছরের একটি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে করছাড় কমানোর সুস্পষ্ট রূপরেখা উল্লেখ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আইন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি রয়েছে, সেগুলো ২০২৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর সীমিত আকারে থাকবে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে যেসব খাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে করছাড় দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো তুলে নেওয়া হবে।
প্রতিবছর গড়ে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার করছাড় দেওয়া হয়, যা দেশের রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি করে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই করছাড় না থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ানো যেত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে করছাড় কমানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই এই কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব প্রশাসনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, করছাড়ের সুবিধা মূলত সমাজের একটি নির্দিষ্ট সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং কিছু নির্দিষ্ট শিল্পখাতের উদ্যোক্তারাই পাচ্ছেন। এতে দেশে আয় বণ্টনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে এবং জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে করছাড় সীমিত করতে পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে—
১. খাতভিত্তিক করছাড়ের পরিমাণ চিহ্নিত করা
২. এসব ছাড় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা
৩. অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়
৪. করহার কার্যকর করতে মানসম্পন্ন পরিচালন কাঠামো তৈরি
৫. ধাপে ধাপে ভ্যাটছাড় প্রত্যাহার
এই কার্যক্রমগুলো করনীতি, ভ্যাটনীতি ও কাস্টমস নীতি বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে এবং ২০২৭ সালের প্রথমার্ধের মধ্যেই তা শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত তিনটি আলাদা প্রতিবেদনে করছাড়ের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এক অর্থবছরে আয়কর, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক এবং আবগারি শুল্ক মিলিয়ে মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪১০ কোটি টাকার করছাড় দেওয়া হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি করছাড় হয়েছে ভ্যাট খাতে—প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। যা আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৮২ শতাংশ। ছাড় না থাকলে আদায় হতো ২ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
আয়কর খাতেও ছাড়ের পরিমাণ আদায়ের চেয়ে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেখানে আদায় ছিল ৮৭ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। কর অবকাশ সুবিধা ও উৎসে করকে চূড়ান্ত হিসেবে ধরার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
একইভাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা।
গত পাঁচ দশকে ২০০টিরও বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে করছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন এসব প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে বাতিলের লক্ষ্যে একটি বিশেষ দল কাজ করছে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।