২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বাদ পড়ে ব্রাজিল। হারের পরের দিন ফিফার সঙ্গে কথা বলেন জিকো। রিয়াল মাদ্রিদে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের উন্নতি নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে কার্লো আনচেলত্তির প্রসঙ্গ টানেন ‘সাদা পেলে’, ‘জিদানের অধীনে ভিনিসিয়ুস খুব বেশি সুযোগ পায়নি…আনচেলত্তি আসার পর সে নিজেকে মেলে ধরেছে। যদি আমাকে তিতের (২০২২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল কোচ) জায়গায় কাউকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে সেটা হবে একজন বিদেশি কোচ এবং আমার তালিকায় তার নামটাই প্রথমে থাকবে। আনচেলত্তি ব্রাজিলিয়ান ফুটবল পছন্দ করেন এবং ব্রাজিলের ফুটবল সম্পর্কে তার জানাশোনাও ভালো।’
ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনই (সিবিএফ) নাকি প্রথম আনচেলত্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে জাতীয় দলের জন্য। ২০২৩ সাল থেকে সিবিএফ এই ইতালিয়ান কোচের পেছনে ছুটছে—সে কথা সত্যি হলেও জিকো তার আগেই ব্রাজিলের দুর্দশা কাটাতে ‘ডন কার্লো’র কথা বলেছিলেন। সেটা শুধু ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে তাঁর থরে–বিথরে সাফল্যের কারণে নয়। খেলোয়াড় আনচেলত্তির দর্শনও কিন্তু জিকোর জানা ছিল তাঁর এক সতীর্থের কল্যাণে।
পাওলো রবার্তো ফ্যালকাও। ব্রাজিল তো বটেই ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। ইতালিয়ান ক্লাব রোমায় আনচেলত্তির সতীর্থ থেকে বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ফ্যালকাও। দুজনে মিলে রোমায় জিতেছেন ১৯৮৩ সিরি আ। সেই বন্ধুত্ব আছে এখনো। ২০২২ সালে রিয়াল মাদ্রিদে দেখা হয়েছে দুজনের। আর ব্রাজিল জাতীয় দলের সতীর্থ ফ্যালকাওয়ের মুখে আনচেলত্তির গল্প শুনেছেন জিকো। এরপর ১৯৯৪ বিশ্বকাপে আরিগো সাচ্চির সহকারী কোচ হিসেবে ইতালির সঙ্গে আনচেলত্তিও উঠলেন ফাইনালে। সেই বিশ্বকাপ জয়ের পথে ব্রাজিল আনচেলত্তিকে খুব কাছ থেকে ভালোভাবে দেখেছে।
আনচেলত্তির বাকি পথটা জিকোর মতো সবারই জানা।
‘বি সকার’ এর হিসাবে, ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে আনচেলত্তি এখন চতুর্থ সর্বোচ্চ (৩১) শিরোপাজয়ী কোচ। প্রথম কোচ হিসেবে জিতেছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। এমন কোচকে কে না পেতে চাইবে! কিন্তু ব্রাজিল তথা সিবিএফের এই চাওয়ার পেছনে শুধু আনচেলত্তির সাফল্য নয় আরও একটি বিষয় আছে, যেটা জিকো বলেছেন ফিফাকে। ব্রাজিলের ফুটবল ও ফুটবলারদের সম্পর্কে জানাশোনা। উল্টো দিক থেকে ভাবলে আনচেলত্তিরও ব্রাজিলের কোচ হওয়ার পেছনে এ বিষয়টির প্রভাব ছিল।
আরও একটি বিষয়—রিয়াল কোচ হিসেবে এ কোচ আগে একবার বলেছিলেন, ক্লাব ফুটবলে মাদ্রিদের ক্লাবটিই হবে তাঁর শেষ চ্যালেঞ্জ। বয়স তো কম হলো না! এখন তাঁর ৬৫ বছর চলে। তাহলে এরপর ব্রাজিলের দায়িত্ব নেওয়া কেন? উত্তর হলো, এর আগে কখনো জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব না নেওয়া আনচেলত্তি তাঁর সিভিতে এই ফাঁকা জায়গাটিও পূরণ করতে চেয়েছেন এবং সেটা যদি হয় পাঁচবার বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল তাহলে একদমই সোনায় সোহাগা।
কারণ? ক্লাব ফুটবলে যেমন রিয়াল মাদ্রিদ, জাতীয় দলের মধ্যেও তেমনি ব্রাজিলের ওপরই সবার চোখ থাকে বেশি। আলোচনা–সমালোচনা সবই একটু বেশি হয় এ দুটি দল নিয়ে। রিয়াল কোচ হিসেবে আনচেলত্তির দুই মেয়াদে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ছয় বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগবে ব্রাজিল দলে। কারণ, তারকার ভারে–ধারে ও প্রত্যাশায় রিয়াল ও ব্রাজিলের মধ্যে বড় পার্থক্যই হচ্ছে—একটি ক্লাব, আরেকটি জাতীয় দল। আর সবাই জানে তারকা থেকে সাধারণ খেলোয়াড় সামলানোয় আনচেলত্তির জুড়ি মেলা ভার। অর্থাৎ আনচেলত্তির ব্রাজিল–সংযোগ আসলে হুট করে মিলে যাওয়া অঙ্ক নয়, দুই পক্ষের তরফ থেকেই দীর্ঘদিনের হিসাব–নিকাশ মিলেছে একই মোহনায়।
সেই মোহনা থেকে এখন অনুচ্চারে একটি ধ্বনিই শোনা যাচ্ছে—ব্রাজিলকে কেউ বিশ্বকাপ জেতাতে পারলে সেটা আনচেলত্তিই পারবেন।
এই কথা শুনে যে প্রশ্নটি অবধারিত, সেটা হলো কেন ও কীভাবে?
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আগেই বলা হয়েছে—ব্রাজিল ফুটবলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমন্ধে ভালো জানাশোনা। দেশটির অতীত কিংবদন্তিদের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া। পাশাপাশি বর্তমান একটি বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলা বর্তমান তারকা খেলোয়াড়দের অধিকাংশেরও খোলনলচে জানেন আনচেলত্তি।
ফিফার তথ্যমতে, ক্লাবে কোচিং ক্যারিয়ারে ৪০ জনের বেশি ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়কে নিজের অধীনে পেয়েছেন আনচেলত্তি। এর মধ্যে অনেকেই তারকা এবং কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। পার্মার কোচ হিসেবে পেয়েছেন জে মারিয়া, আদাইলতন, আমারালকে। জুভেন্টাসে ছিলেন এথিরসন। এসি মিলানে পেয়েছেন কিংবদন্তিদের—দিদা, কাফু, কাকা, রোনালদিনিও, রোনালদো। পাশাপাশি আলেক্সান্দার পাতো, রকি জুনিয়র, এমারসন, লিওনার্দোরাও ছিলেন। চেলসিতে রামিরেস, ডেভিড লুইজ; পিএসজিতে থিয়াগো সিলভা ও লুকাস মউরা। বায়ার্ন মিউনিখে রাফিনিয়া ও ডগলাস কস্তা। এভারটনে রিচার্লিসন, বের্নার্দ ও অ্যালেন। রিয়াল মাদ্রিদে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো, এদের মিলিতাও, এনদ্রিক, মার্সেলো, কাসেমিরো, লুকাস সিলভা, ভিনিসিয়ুস তোবিয়াস ও উইলিয়ান হোসে।
ব্রাজিল জাতীয় দলে এখন নিয়মিত, এমন ছয়জন খেলোয়াড়কে এরই মধ্যে ক্লাব ফুটবলে কোচিং করিয়েছেন আনচেলত্তি। নামগুলো সবারই জানা—রিয়ালে ভিনি, রদ্রিগো, এনদ্রিক, মিলিতাও এবং একসময় পেয়েছিলেন কাসেমিরোকে, যাঁকে জাতীয় দলে ফেরাতে আনচেলত্তি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানিয়েছে গ্লোবো স্পোর্তে। আনচেলত্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই ভালো। কাসেমিরোর বয়স হলেও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে তাঁর কাঁধেই নেতৃত্ব তুলে দিতে চান আনচেলত্তি। এভারটনে পাওয়া রিচার্লিসনকেও ভুলে গেলে চলবে না।
আর আছেন কাকা। হ্যাঁ, ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক মিডফিল্ডার। এসি মিলানে এই আনচেলত্তির অধীনেই ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন কাকা। সিএনএন ব্রাজিলের সঞ্চালক বেঞ্জামিন ব্যাকের দাবি, ব্রাজিল জাতীয় দলে নিজের সহকারী হিসেবে কাকাকে নিয়ে আসতে চান আনচেলত্তি। দুই পক্ষের মধ্যে নাকি এ নিয়ে যোগাযোগও হয়েছে। আরও একটি বিষয় ভুললে চলবে না, ব্রাজিলের যে দুজন ফুটবলার সর্বশেষ বর্ষসেরার পুরস্কার জিতেছেন, দুটোই কোচ আনচেলত্তির অধীনে। কাকার কথা তো বলাই হলো। ২০২৪ সালে ফিফা বেস্ট জেতেন রিয়াল উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস।
ব্রাজিলের সাবেকরাও কিন্তু আনচেলত্তির পাশে আছেন। আনচেলত্তি ‘সেলেসাও’দের কোচ হওয়ার পর দুঙ্গা থেকে রিভালদো কিংবা মাউরো সিলভাদের মুখে বারবার উঠে এসেছে তাঁকে সাহায্য করার কথা। এখন একটাই প্রশ্ন—২০২৬ বিশ্বকাপ মাথায় রেখে মাত্র এক বছরের মধ্যে ব্রাজিল জাতীয় দলকে কতটা গুছিয়ে নিতে পারবেন আনচেলত্তি? ২৬ মে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাজিলের দায়িত্ব নেবেন তিনি।
২০০২ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল। এরপর এই ২৩ বছরে পাঁচটি বিশ্বকাপে প্রতিবারই ইউরোপিয়ান প্রতিপক্ষের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে দলটি। ইউরোপিয়ান এই ‘ধাঁধা’র সমাধান বের করতে আনচেলত্তির চেয়ে ভালো আর কে হতে পারেন! ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে যাঁর ২৮ বছরের কোচিং অভিজ্ঞতা এবং সেই পথে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের সংস্পর্শে এসে তাঁদের যেমন প্রভাবিত করেছেন, তেমনি নিজেও কিছু না কিছু নিয়েছেন লাতিন সংস্কৃতি থেকে—সেই আনচেলত্তিই হতে পারেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান–ধাঁধার সমাধান।
সে জন্য একজন খেলোয়াড়ের একটু বেশি ভূমিকা রাখা যেন সময়ের দাবি। নেইমার!
৩৩ বছর বয়সী এই ফুটবলার আগেই বলেছেন, আগামী বিশ্বকাপই হয়তো তাঁর শেষ। স্বাভাবিকভাবেই শেষটা রাঙিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর থাকবেই। কিন্তু চোট ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন তাঁকে বারবার মাঠের বাইরে ছিটকে ফেলে এবং এখন যেমন বাইরে আছেন চোটের কারণেই। গ্লোবো স্পোর্ত জানিয়েছে, সিবিএফের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত করার সময়ই নেইমারের সঙ্গে যোগাযোগটা সেরেছেন আনচেলত্তি। তাঁকে ফিট ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে আনচেলত্তির চেয়ে ভালো ‘ম্যান ম্যানেজার’ সম্ভবত আর নেই।
বাকিটা ছেড়ে দেওয়া যাক সময়ের ওপর। ‘ব্যামো’ সারাতে ব্রাজিল সেরা ‘ওষুধ’টিই এনেছে ঘরে। এখন তা কাজে লাগার অপেক্ষা।
তবে সবার আগে আনচেলত্তিকে আগে ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পাইয়ে দিতে হবে ব্রাজিলকে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আগামী ৬ জুন ইকুয়েডরের মুখোমুখি হবে ব্রাজিল। এরপর ১১ জুন তাদের প্রতিপক্ষ প্যারাগুয়ে। ১৪ ম্যাচে ২১ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাই টেবিলে চতুর্থ ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেলা এরই মধ্যে নিশ্চিত করলেও ব্রাজিলকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
বিশ্বকাপের পরিবর্তিত কাঠামো অনুযায়ী দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ২০২৬ বিশ্বকাপের টিকিট পাবে ছয়টি দেশ। সপ্তম দলটিকে প্লে অফ খেলে আসতে হবে।