জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র পোশাক খাতেই শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্দোলনের ফলে সরকার ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করলেও এটি এখনও দেশের মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩৫ শতাংশ, ফলে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে কার্যত তা হ্রাস পেয়েছে।
চামড়া খাতে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হলেও শ্রমিকদের দাবি, সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। অন্য কোনো খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার থেকে কোনো ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি ৬৫ লাখ শ্রমিক রয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই কাজ করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা ছিল বড় ধরনের পরিবর্তনের। কিন্তু বাস্তবে তা খুব একটা হয়নি। বরং বিভিন্ন শ্রমঘন এলাকায় আন্দোলন, বিক্ষোভ, এবং বকেয়া মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বেক্সিমকো শিল্পপার্কসহ বেশ কিছু কারখানায় লে-অফ ঘোষণা করা হয়, যা প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিককে প্রভাবিত করে। তাদের পাওনা পরিশোধে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ কিছুটা কার্যকর হলেও সামগ্রিকভাবে শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বর্তমানে তিনটি বড় উদ্যোগে যুক্ত—শ্রমিক ও মালিকপক্ষের যৌথ ১৮ দফা ঘোষণা, শ্রম আইন সংশোধনের কার্যক্রম, এবং শিল্প পার্কগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন। তবে এই ১৮ দফা ঘোষণার বেশিরভাগই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
টিফিন ভাতা, নাইট বিল এবং হাজিরা বোনাস কিছুটা বাড়ানো হলেও টিসিবি পণ্য ও ওএমএসের চাল সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে শ্রমিকদের তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নিহত ও আহতদের তালিকাও জমা দেওয়া হয়েছে, তবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিনের পরিবর্তে ১২০ দিন নির্ধারণের ঘোষণার বাস্তবায়ন আংশিক।
চামড়া শিল্পে ঘোষিত নতুন ন্যূনতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা হলেও ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি কোনো কারখানায়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য এখনো কোনো কার্যকর সংস্কার নেওয়া সম্ভব হয়নি। শ্রম আইন সংশোধনের পর এই বিষয়ে নজর দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
এদিকে শ্রমিকদের ভবিষ্য তহবিল, গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক না করা এবং স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার না রাখা নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার না রাখার প্রস্তাবিত আইন শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
আজ ১ মে, মহান মে দিবসে এই বাস্তবতা সামনে এসেছে। ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’—এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দিবসটি পালিত হলেও বাস্তবে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক, ন্যায্য মজুরি এবং শ্রমিক অধিকারের বাস্তবায়ন এখনও অনেক পিছিয়ে।